দুই শিক্ষার্থীর আন্তর্জাতিক সাফল্য
সম্প্রতি ফিলিপাইনের বোরাকা উপদ্বীপে এশিয়ার ২২টি দেশ থেকে স্থপতিদের সংগঠন ‘ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস’ নিয়ে আয়োজন হয় এক মিলনমেলা। ২০তম এ আয়োজনকে আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল এশিয়া, যাকে সংক্ষিপ্তরূপে আর্কএশিয়া শিরোনামে নামকরণ করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব আর্কিটেক্টস প্রতি বছর স্থাপত্যসংক্রান্ত নানা প্রতিযোগিতা ও সেমিনার আয়োজন করে।
সেপ্টেম্বরের ১৭ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত এবারের আয়োজনে বছরের সেরা গবেষণা বিভাগে রৌপ্যপদক জিতেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফাহিম আসহাব ফারুকী। ব্রোঞ্জ জিতেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্রী ইসরাত জাহান।
পদ্মা সেতু ঘিরে ফাহিমের পরিকল্পনা
ফাহিমের গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘ইকোস অব রিপ্লেনিশমেন্ট’, অর্থাৎ পরিপূরণের প্রতিধ্বনি। পদ্মা সেতু স্থাপনার জন্য নির্বাচিত এলাকাটি সেতু নির্মাণের পরে কার্যকরভাবে ব্যবহার করাই ছিল গবেষণার মূল বিষয়। নির্বাচিত এলাকাটি মাওয়া প্রান্তে ২১.৪ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এবং সেতুর স্প্যানশেডের ক্ষেত্রফল ৬.০১ একর। গবেষণায় সেতুর স্থাপত্য শেডকে পুনরুদ্ধার করা, জায়গাটিতে নতুন প্রাণের প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি নদী বিসৃত সেতুর চিত্তাকর্ষক গল্প তুলে ধরার লক্ষ্যে সেখানে জাদুঘর তৈরির নকশা করা হয়েছে।
জাদুঘরের কমপ্লেক্স আশপাশের ভূদৃশ্যের সঙ্গে সমন্বিত করে এমন একটি চিত্তাকর্ষক পরিবেশ ও পার্ক ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে পর্যাপ্ত বায়ুসঞ্চালন এবং দর্শক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে আগত দর্শনার্থীদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আরও সুন্দর করতে বহিরঙ্গনে বিশ্রাম, বিনোদন ও জনসমাবেশমূলক কাজে অংশ নেওয়া যাবে। মূল আকর্ষণ হিসেবে একটি পাবলিক প্লাজা রয়েছে, যা বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা জনসমাগমের জন্য একটি স্থান হিসেবে কাজ করে। দর্শনার্থীদের জন্য সুবিধা এবং প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত পার্কিং ও ড্রপ-অফ এলাকা ভূ-নির্মাণ পরিকল্পনায় সংযুক্ত করা হয়েছে।
পদ্মা নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে দর্শকদের সম্পূর্ণরূপে বিমোহিত এবং নদীর সমৃদ্ধ জলজীবন দৃষ্টিগোচর করতে জাদুঘরটি বিভিন্ন মিথস্ক্রিয়ামূলক প্রদর্শনী, অ্যাকোয়ারিয়াম এবং নিমজ্জিত স্থাপনা ব্যবহার করে। জাদুঘরটিতে আকর্ষণীয় নৌকা প্রদর্শনীও রয়েছে যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক এবং পুরোনো নৌকা, নদীজীবনের সংস্কৃতি এবং লোককাহিনীর গ্যালারি, নদীর ইতিহাস, নদীবাস্তুশাস্ত্র এবং বিশ্ববিখ্যাত নদীর সেতুসমূহ বিদ্যমান।
পদ্মা সেতু জাদুঘরটির পদ্মা সেতু গ্যালারিতে একটি উন্মুক্ত পরিদর্শন ডেক রয়েছে যা থেকে সেতুটির একটি রাজকীয় দৃশ্য অবলোকন করা যায়। প্রকল্পের গবেষণাগার অংশটি পদ্মা নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বিষয় গভীরভাবে অধ্যয়ন এবং বিশ্লেষণ পরিচালনা করে, পাশাপাশি এর পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক দিকগুলো অন্বেষণ করে। পুরস্কার গ্রহণের অনুভূতি ব্যক্ত করে ফাহিম বলেন, ‘আমি ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) ও চুয়েটেরও প্রতিনিধিত্ব করেছি।
এটা আমার কাছে বড় আনন্দের। আর্কএশিয়ার এ স্বীকৃতি আরও বহুদূর যেতে প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।’ এ গবেষণা প্রকল্পের যৌথভাবে তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা তাসনিম এবং ইউনিভার্সিটি এশিয়া প্যাসিফিকের সহযোগী অধ্যাপক জিয়াউল ইসলাম। উল্লেখ্য, একই প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্রী ইসরাত জাহান।
ইসরাতের ভাবনায় উপকূলের মানুষ
বিশাল বিশাল ভবন কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকে! ছেলেবেলার এ কৌতূহলের তাড়নাতেই বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ইসরাত জাহান। ইসরাত বলছিলেন, ‘আমি সব সময় স্থাপত্যের মাধ্যমে মানুষের জীবন প্রভাবিত করতে চেয়েছি।’
যে থিসিসের জন্য আর্কএশিয়ায় ব্রোঞ্জপদক পেয়েছেন স্থাপত্যের এই শিক্ষার্থী, সেটিও মানুষের জীবনকেন্দ্রিক। কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার উপকূলবর্তী মানুষ নিয়ে ভেবেছেন ইসরাত, তৈরি করেছেন এমন এক স্থাপনার প্রোটোটাইপ, যা সাধারণ সময়ে ‘কমিউনিটি স্পেস’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে আর দুর্যোগের সময় হয়ে উঠবে আশ্রয়কেন্দ্র। পরিবেশবান্ধব এবং স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রটি তৈরির নকশা করেছেন ইসরাত। তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো এমন একটা সম্প্রদায় গড়ে তোলা, যারা ভবিষ্যতের জন্য তৈরি থাকবে। থিসিসে সার্বিক সহযোগিতার জন্য আমি ধন্যবাদ দিতে চাই আমার শিক্ষক বুয়েটের অধ্যাপক খন্দকার সাব্বির আহমেদ ও সহকারী অধ্যাপক মাহেরুল কাদেরকে। আর্কএশিয়ায় পুরস্কারের চেয়েও বড় প্রাপ্তি হলো একটি বড় নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে পারা। ভবিষ্যতে এ প্রেরণা কাজে লাগাতে চেষ্টা করব।’