সুমাইয়া যেভাবে প্রথম হলেন

রাতারাতি সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে সুমাইয়া মোসলেমের নাম। মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে খুলনার এই মেয়ে—এ কথা এখন অনেকেরই জানা। ৭ এপ্রিল আমরা গিয়েছিলাম সুমাইয়ার কাছে। জানতে চেয়েছিলাম, ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষায় এত ভালো ফলাফল অর্জনের পেছনে কী ছিল তাঁর কৌশল? কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন তিনি?

প্রকৌশলে প্রস্তুতি, মেডিকেলে প্রথম
মেডিকেল কলেজের ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষায় সুমাইয়া মোসলেম পেয়েছেন ৯২ দশমিক ৫। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় যেহেতু জিপিএ–৫ পেয়েছেন, তাই ৩০০ নম্বরের মধ্যে তাঁর মোট অর্জন ২৯২ দশমিক ৫। অথচ এইচএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত নাকি প্রকৌশলী হবেন বলেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় সুমাইয়ার গ্রামের বাড়ি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষায় নিজ জেলায় পেয়েছিলেন সেরার স্বীকৃতি। এসএসসি পর্যন্ত সেখানেই পড়ালেখা করেছেন। মেয়ের পড়াশোনার সুবিধার্থে এক সময় সপরিবারে খুলনা শহরে চলে আসেন বাবা মোসলেম উদ্দিন সরদার। সুমাইয়াকে ভর্তি করা হয় খুলনার সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল (এমএম) কলেজে।

গ্রামের স্কুলজীবনটা নাকি স্বপ্নের মতো ছিল। শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছেন সব সময়। শহরে আসার পর শুরুতে মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, গ্রামের আর শহরের শিক্ষকদের পড়ানোর ধরন আলাদা। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই শহুরে কলেজজীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন তিনি।

সুমাইয়ার বাবা মোসলেম উদ্দিন ডুমুরিয়া কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, আর মা খাদিজা খাতুন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। চাকরি করেন যশোরের কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে। মেয়ের পড়াশোনায় যেন বিঘ্ন না ঘটে, তাই খুলনা থেকে প্রতিদিন মা কেশবপুরে আর বাবা ডুমুরিয়ায় গিয়ে চাকরি করতেন।

গণিতে ভালো দখল আছে বলেই প্রকৌশলী হতে চেয়েছিলেন সুমাইয়া। এইচএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত সেভাবেই চলছিল প্রস্তুতি। তবে পাঁজিয়া উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে সুমাইয়ার মায়ের একসময়ের সহকর্মী, চিকিৎসক সায়েমের পরামর্শে তিনি মেডিকেলে পড়তে আগ্রহী হন।

করোনার বদ্ধ সময়ে
২০১৯ সালের আগস্টে শুরু হয় সুমাইয়ার কলেজজীবন। কয়েক মাস পরই শুরু হয় করোনা। সে সময় সপরিবারে আবার গ্রামে ফিরে যায় সুমাইয়ার পরিবার। প্রথম ছয় মাস তাঁরা বাড়িতেই ছিলেন। করোনার আতঙ্ক, নানা সংকটে শুরুর দিকে পড়ালেখা সেভাবে করা হয়নি। প্রায় পাঁচ মাস বিরতির পর আবার পুরোদমে পড়ালেখায় মন দেন তিনি। গণিত ও ইংরেজি বিষয় দুটির ওপর জোর দিয়ে চলতে থাকে পড়াশোনা।

নভেম্বরে আবার খুলনা শহরে ফেরেন তাঁরা। কলেজ তখন ক্লাস বন্ধ। তাই ইউটিউব দেখে, অনলাইনের মাধ্যমে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সুমাইয়া। পাশাপাশি নিয়মিত দুজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তেন।

সব সময় কি তাহলে শুধু পড়া আর পড়া? আর কিছুতে আগ্রহ নেই, জানতে চাই। সুমাইয়া বলেন, ‘গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে। গোয়েন্দা গল্প আমার বেশি পছন্দ। সায়েন্স ফিকশন ভালো লাগে। এ ছাড়া গান শুনেও অবসর সময়টা ভালো কাটে।’

বুঝে পড়া ও মডেল টেস্ট
প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী এ বছর মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় আবেদন করেছিলেন। সবাইকে পেছনে ফেলে প্রথম হয়েছেন যে মানুষটা, নিশ্চয়ই তাঁর প্রস্তুতিতে বিশেষ কিছু ছিল। কী সেটা? সুমাইয়া বলেন, ‘তেমন কিছু না। আমি শুধু সব সময় বুঝে পড়ার চেষ্টা করেছি। বেসিকটা মনে রাখতে চেয়েছি। এটাই সম্ভবত আমার কাজে লেগেছে। মুখস্থ যে করতাম না, তা না। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান আর রসায়ন—এই দুইটা বিষয় সব সময় বুঝে পড়েছি। অনলাইনে, অফলাইনে প্রচুর মডেল টেস্ট দিয়েছি। ফলে নিজের দুর্বলতা, ভুলগুলো ধরা পড়েছে। সেগুলোর ওপর আরও বেশি জোর দিয়েছি।’

মাথা ঠান্ডা রেখে কীভাবে পরীক্ষা দিয়েছেন, সে কথাও বলছিলেন তিনি, ‘এমনিতেই পরীক্ষা নিয়ে আমার খুব বেশি টেনশন হয় না। আর প্রশ্ন হাতে নিয়ে মনে মনে নিজেকে বলি, প্রশ্নপত্র তো সহজ, আমি পারব।’

যখন জানলাম, প্রথম হয়েছি
মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ৫ এপ্রিল। এক বড় ভাইয়ের ফোন পেয়ে সুমাইয়া জানতে পারেন, তিনি প্রথম হয়েছেন। শুরুতে বিশ্বাসই করতে পারেননি। পরে আরেক বড় ভাই রেজাল্ট শিটের ছবি তুলে পাঠান। সেই ছবি দেখেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না সুমাইয়া। এমনকি বাসায় তখনো কিছু জানাননি তিনি।

একটু পর বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের লোকজন আর শুভাকাঙ্ক্ষীরা আসতে শুরু করেন। তাঁদের সামাল দিতে অফিস থেকে বাড়ি চলে আসেন বাবা। সুমাইয়াদের পরিবারে নামে খুশির ঢল।

মেডিকেলে ভর্তি–ইচ্ছুকদের জন্য সুমাইয়ার ৫ পরামর্শ
১. একাডেমিক বইকে গুরুত্ব দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। মূল বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। একাডেমিক বইয়ে ভালো দখল থাকলে অন্য বইকে সহায়ক হিসেবে রাখা যেতে পারে।

২. বুঝে পড়ার কোনো বিকল্প নেই।

৩. রিভিশন দিতে হবে বারবার।

৪. প্রচুর মডেল টেস্ট দিতে হবে। এতে নিজের দুর্বলতাগুলো ধরা পড়বে। তখন দুর্বলতা কাটানোর ওপর জোর দেওয়া যাবে।

৫. প্রতিদিন কমপক্ষে আট ঘণ্টা পড়ালেখার পেছনে ব্যয় করতে পারলে ভালো। আজকের পড়া কালকের জন্য ফেলে রাখা যাবে না।