রাবির ফাইনাল প্রফে সেরা ডা. নিকিতা রহমান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) অধিভুক্ত ২৪টি মেডিকেল কলেজের নভেম্বর ২০২১ এর এমবিবিএস চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) শিক্ষার্থী ডা. নিকিতা রহমান। ২০১৬-১৭ সেশনে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় সারাদেশে সম্ভবত ৮২৪তম হয়েছিলেন তিনি। ডা. নিকিতার জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজশাহী জেলায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও রাজশাহী কলেজ থেকে এইচএস পাস করেছেন তিনি।
বাবা-মা ও বড় বোন নিয়ে ডা. নিকিতার পরিবার। তাঁর পরিবারের সবাই চিকিৎসক। বাবা-মা ছিলেন রামেকের ২৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বাবা চক্ষু বিশেষজ্ঞ, মা শিশু বিশেষজ্ঞ। নিকিতা রামেকের ৫৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। একমাত্র বড় বোন ঢাকার আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। তিনিও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার পথে।
ছোট বেলা থেকে কঠোর অধ্যাবসায় ও নিয়মিত প্রচেষ্টায় সব শ্রেণিতে শীর্ষে ছিলেন ডা. নিকিতা রহমান। সব কিছু ছাপিয়ে গতকাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশিত ফলাফলে ২ হাজার ৩৫৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কৃতকার্য ১ হাজার ৫৬২ জন চিকিৎসকের মাঝে একমাত্র অনার্স মার্ক পেয়েছেন তিনি। আজ বুধবার (২৯ জুন) বিকেলে নবীন এ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয় মেডিভয়েস প্রতিবেদকের। আলাপচারিতায় উঠে আসে ঈর্ষণীয় সাফল্যের নেপথ্য কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: সাখাওয়াত হোসাইন।
মেডিভয়েস: আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
ডা. নিকিতা রহমান: সৃষ্টিকর্তা কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। ভালো ফলাফল করতে পেরে আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে।
মেডিভয়েস: কোন অনুপ্রেরণায় এ পর্যন্ত আসা?
ডা. নিকিতা রহমান: আমার মূল অনুপ্রেরণা মা-বাবা, আর পরিবার। আসলে এতদূর আসার পেছনে আমার বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, সিনিয়র সবারই ভূমিকা রয়েছে। মেডিকেলের ভালো রেজাল্টের পেছনে থাকে টিম ওয়ার্ক। হতে পারে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, সিনিয়রদের সাথে। স্থানীয় হওয়ায় আমি বাসায় থেকেই পড়াশোনা করেছি। আমার পরিবার অভাবনীয় সহযোগী মনোভাবাপন্ন। আমার আব্বু-আম্মু ও বড়বোন সবাই চিকিৎসক। তাদের সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তারা আমাকে সবচেয়ে বেশি মানসিক সাপোর্ট দিত। পরিবারের সবাই চিকিৎসক হওয়ায় আমার জন্য যাত্রাটা অনেক সহজ ছিল। দেখা যায়, আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব অকৃতকার্য হতো, বাসায় বলতে পারতো না। পরীক্ষায় খারাপ হলে বাসায় বোঝাতে পারতো না। কিন্তু মেডিকেলে শুধু একটা পাসও যে কত মূল্যবান আমার পরিবার সেটা বুঝতো। একটা পরীক্ষাতে শতভাগ প্রস্তুতি থাকার পরও খারাপ হতে পারে, আমার পরিবার সেটা বুঝতো। এটা অনেক বড় সাপোর্ট। আমি একজন নারী শিক্ষার্থী।লাইব্রেরিতে গিয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করি। অনেক সময় ওয়ার্ডে সার্জারি বা ওটি থাকলে অনেক রাত পর্যন্ত থাকা লাগতো—এসব ব্যাপারে আমার পরিবার অনেক সহায়তা করতো ও স্বাধীনতা দিয়েছে আমাকে। আমার বড় বোন পাঁচ বছরের সিনিয়র, তিনিও আমাকে সাপোর্ট দিতেন।
মেডিভয়েস: কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চান?
ডা. নিকিতা রহমান: আমার ইচ্ছা আছে সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়া, আর সাব-স্পেশালিটির বিষয়ে এখনও ভাবিনি। সার্জারির কাজগুলো আমার কাছে ভালো লাগে। আমার শিক্ষা জীবনে যতটুকু দেখেছি, আমার মনে হয়েছে আমি পারবো।
মেডিভয়েস: সার্জারিতে কাটা-ছেড়ার কাজ বেশি, এ বিষয়ে সাধারণত পুরুষেরা অধিক আগ্রহী, আপনার অনুরাগের কথা শুনতে চাই।
ডা. নিকিতা রহমান: সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়া অনেক সাহসের ব্যাপার। দ্বিতীয়ত ঢাকার বাইরে পেরিফেরিতে মেয়ে সার্জনের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু সার্জারিতে গাইনির মতো অনেক সমস্যা আছে। আমাদের সমাজের মেয়েরা অনেক বিষয় নিয়ে পুরুষ চিকিৎসকের কাছে যেতে সংকোচবোধ করেন। এখন অনেক মেয়েরা সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য আসছেন। আমিও মেয়েদের সেবা করতে পারবো।
মেডিভয়েস: যারা অকৃতকার্য হয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ জানতে চাই?
ডা. নিকিতা রহমান: যারা অকৃতকার্য হয়েছেন, তাদের বিষয়ে আমার প্রধান পরামর্শ হলো ধৈর্য। আমাদের এনাটমির শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রেজা স্যার বলতেন, মেডিকেলে কৃতকার্য হওয়ার জন্য তিনটা বিষয় প্রয়োজন, তা হলো ভাগ্য, শ্রম ও ত্যাগ। বাস্তবতা হলো শতভাগ প্রস্তুতি থাকার পরও পাস করবেন না ফেইল করবেন, সেটা নির্ভর করে আপনার ভাগ্যের উপর। যারা অকৃতকার্য হয়েছেন, পড়াশোনা সবাই করেছেন, কিন্তু তাদের ভাগ্যটা হয়তো সহায় হয়নি। সুতরাং তাদেরকে আমি বলবো ধৈর্য ধরতে। কারণ আমি আমার পরিবারে কাছ থেকে দেখেছি, মেডিকেলের পথ অনেক লম্বা। চিকিৎসকদের এমবিবিএস লাইফের পর থেকে প্রত্যেকটা মূহূর্তে প্রস্তুত থাকতে হয়। শতভাগের মধ্যে প্রত্যেকটা পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ পাস আর ৫০ শতাংশ ফেইল আসতে পারে, এমন মন-মানসিকতা নিয়ে থাকতে হবে। সুতরাং কে কোথায় আগাবে বা পিছাবে বলা যায় না। এতো তাড়াতাড়ি হতাশ হলে চলবে না। আমার রেজাল্ট দিয়েছে, সাপ্লি পরীক্ষা অতি সন্নিকটে। ধৈর্য ধরে নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
মেডিভয়েস: পরীক্ষার প্রস্তুতি ও কৌশল সম্পর্কে জানতে চাই।
ডা. নিকিতা রহমান: করোনায় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। আমরা ফিজিক্যাল ক্লাসগুলো খুব কম পেয়েছি। দেড় বছরের ওয়ার্ডের জায়গায় আমরা মাত্র চার মাসের ব্লক পোস্টিং পেয়েছি। আর অনলাইন ক্লাস ছিল আরও চার মাস। আমাদের প্রস্তুতিটা খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে নিতে হয়েছে। আমি প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম লিখিত প্রশ্ন দেখে। আর প্রতিদিন সেই অনুযায়ী পড়াশোনা করতাম। সব সময় স্যার বা ম্যামরা ক্লাসে কি বলছেন, সেগুলো অনুসরণ করতাম। অনলাইন ক্লাসে যেগুলোতে সমস্যা হতো সেগুলো আমি বিভিন্ন মাধ্যমে ভালোভাবে দেখে নিতাম। আমি ওয়ার্ডে গিয়ে ফোকাস করেছি ক্লিনিক্যাল দিকটায়। যতক্ষণ ওয়ার্ডে থাকতাম, চেষ্টা করতাম পরীক্ষাগুলো চর্চা করতে ও আয়ত্ত্বে আনতে। ব্লক পোস্টিংয়ের চারটা মাস কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। অতিরিক্ত না পড়ে কোন প্রশ্নগুলো বেশি ধরছে বা জরুরি ক্লিনিক্যাল লাইফে কাজে লাগবে সেগুলোর দিকে ফোকাস করেছি।
মেডিভয়েস: অনেকেই বলেন, মেডিকেলে যে যত বেশি মুখস্ত করতে পারবে, সে তত বেশি ভালো করতে পারবে? এ চিন্তার বিষয়ে আপনার মতামত?
ডা. নিকিতা রহমান: মেডিকেলে তথ্য অনেক। তথ্য মনে রাখার জন্য মুখস্ত বিদ্যা থাকতে হবে। বোঝার বিষয় অসংখ্য, না বুঝে আপনি মুখস্ত করে ধরে রাখতে পারবেন না। মুখস্ত বিদ্যা থাকতে হবে, তবে বুঝে মুখস্ত করতে হবে। না বুঝে মুখস্ত করার মতো জিনিস মেডিকেলে খুবই নগণ্য। চিকিৎসকরা সবাই জানেন, না বুঝে মুখস্ত রাখা অসম্ভব।
মেডিভয়েস: রাবির অধীনে অকৃতকার্য অধিকাংশ শিক্ষার্থীই সার্জারিতে ফেইল করেছেন, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
ডা. নিকিতা রহমান: সার্জারি সাবজেক্টটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় মনে হয়েছে। যারা অকৃতকার্য হয়েছেন, আমি তাদেরকে শুধু একটাই পরামর্শ দিব। ধের্য ধরে সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখে আবার প্রস্তুতি শুরু করতে। যতটুকু সম্ভব নিজেকে সামলে নেওয়া। আমরা ক্লিনিক্যালগুলো সবচেয়ে কম পেয়েছি, অবশ্যই ওয়ার্ডে গিয়ে ক্লিনিক্যাল ক্লাসগুলো করা। ক্লিনিক্যাল দক্ষতাগুলো আয়ত্ত্বে নিয়ে আসা। ক্লিনিক্যাল দক্ষগুলো পরীক্ষার এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ আগে গিয়ে আয়ত্ত্বে আনা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
মেডিভয়েস: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।
ডা. নিকিতা রহমান: আমার ইচ্ছা আছে, ইন্টার্নশিপের পাশাপাশি বিসিএস এবং পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য পড়াশোনা করা। আমার লক্ষ্য সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া। আত্ম-মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার মতো যোগ্য করে তোলা।
মেডিভয়েস: আপনার পারিবারের সবাই চিকিৎসা পেশায় জড়িত। বিষয়টি নিয়ে কেমন লাগে?
ডা. নিকিতা রহমান: খুবই ভালো লাগে। কারণ আমাকে মেডিকেল নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলে, অনেক পড়া, দীর্ঘ শিক্ষাজীবন ইত্যাদি। এই পেশায় মানসিক যে সন্তুষ্টি পাওয়া যায়, অন্য কোথাও পাওয়া যায় কিনা জানি না। এই পেশায় একই সাথে স্বাধীনভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। মানুষের সেবা করতে পারবেন। সৎ থাকাটা অনেক সহজ। এই পেশাটা অনেক সম্মানের। এই পেশাটার নামই সেবা। এখানে সরাসরি মানুষের সেবা করা যায় ও মানুষের দোয়া পাওয়া যায়। ধর্মীয় দিকটা বিবেচনা করলে দেখি, ইহকাল ও পরকাল দুইটিতেই শান্তি পাওয়া যায়।
মেডিভয়েস: এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই, ‘একটি গবেষণায় দেখা গেছে। প্রায় ৩২ শতাংশ মেডিকেল শিক্ষার্থী নিজেকে অযোগ্য ও প্রতারক ভাবেন।’ এ বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখছেন?
ডা. নিকিতা রহমান: যারা ধর্মীয় রীতি-নীতি মানেন বা বিশ্বাস করেন, তাদেরকে বলবো আপনারা সৃষ্টিকর্তাকে বেশি বেশি স্মারণ করুণ। সৃষ্টিকর্তার সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হলে তখন আপনি বুঝতে পারবেন। আপনি একা না। সবসময় সর্বশক্তিমান একজন আছেন, যিনি আপনাকে সাহায্য করেই যাবেন। তিনি আপনার সাথে আছেন। এটা হতাশা দূর করার মূলমন্ত্র। সার্বিকভাবে হতাশা দূর করার জন্য সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করুন। ইতিবাচক কাজগুলো করুন। আপনার হতাশা আশপাশের উপযুক্ত মানুষের সাথে শেয়ার করুন। মেডিকেলে অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ শিক্ষক আছেন। তাদের সাথে কথা বলুন। ভালো ব্যাচমেটদের সাথে শেয়ার করুন। নিজের মধ্যে সবকিছু গুটিয়ে রাখবেন না। মেডিকেলে ধৈর্যের বিকল্প নেই।