মুসলিম বিশ্বের ঐতিহাসিক গ্রন্থাগার

জ্ঞানের খোঁজ করা মুসলিম ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিক্ষা, গবেষণায় মুসলিম মনীষীদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। তাদের হাতে রচিত বিশ্ব সাহিত্য, বিজ্ঞান ও গবেষণাধর্মী কাজগুলো মলাটবন্দী রয়েছে বই ও নথিতে। যুগের পর যুগ ধরে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে এ বইগুলো ভূমিকা রেখে চলেছে। সেসব বই নিয়ে গড়ে উঠেছে লাইব্রেরি। বিশ্বের নানা প্রান্তে রয়েছে এ লাইব্রেরিগুলো। জ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় মানব সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশে সেরাদের কাতারে থাকা মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসেরা লাইব্রেরি নিয়ে আজকের আয়োজন।

আল-কারাউইন মরক্কো

বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থাগার আফ্রিকার মরক্কোতে অবস্থিত আল-কারাউইন। হাজার বছরের বেশি পুরাতন এ গ্রন্থাগার এখনো বিলিয়ে যাচ্ছে জ্ঞানের আলো। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই গ্রন্থাগারে ভিড় করতেন বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জ্ঞানী-গুণী, পর্যটক ও ছাত্র-শিক্ষক। আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার। এখানে আছে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী শিল্পকলা, ইতিহাস-ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রগামী দেশ মরক্কোর অতীত সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য। ইসলামের প্রথম যুগের নানা পান্ডুলিপি পাওয়া যায় এ পাঠাগারে। এর মধ্যে আছে, নবম শতকের একটি আল-কোরআন এবং দশম শতকে লিখিত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবনীর বিভিন্ন অংশ। এ ছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিজ্ঞানের ওপর বই আছে এখানে।

৮৫৯ সালে আরবের ধনী নারী ফাতেমা আল ফিহরির ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফেজ নগরীর কারাউইন নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সে বছরই মসজিদের আঙিনায় তিনি গড়ে তোলেন আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠাগার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৩৫৯ সাল পর্যন্ত একটানা চালু ছিল পাঠাগারটি। তবে বিভিন্ন সময়ের যুদ্ধে উপনিবেশবাদীদের দখল-বেদখলের ঘটনায় ফেজ শহর আঘাতপ্রাপ্ত হলেও আল-কারাউইন মোটামুটি অক্ষতই ছিল। কখনো কখনো বন্ধ থেকেছে বিশাল এ জ্ঞানের ভান্ডার। কয়েক প্রজন্ম ধরে পাঠাগারের রক্ষীরা এসব মূল্যবান তথ্য-উপাত্ত রেখেছেন তালাবদ্ধ। কিন্তু পাঠাগারের অবকাঠামোগত সমস্যা তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে। বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পাঠাগারে প্রবেশ করে নানা রকম ক্ষতি সাধিত হয়েছে। হঠাৎ করে আল-কারাউইনের পাটাতনের নিচ দিয়ে ধীরে ধীরে পানির স্রোত বইতে শুরু করে।

মক্কা লাইব্রেরি সৌদি আরব

ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগার মক্কা লাইব্রেরি। আব্বাসীয় শাসক খলিফা মাহদির শাসনামলে সৌদি আরবে সাফা-মারওয়া সা’ঈর থেকে পূর্ব পাশে ১৬০ হিজরিতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩৫৭ হিজরিতে বাদশা আবদুল আজিজের শাসনামলে প্রথম এর নামকরণ করা হয় ‘মাকতাবাতুল হারাম আল-মাক্কি’। প্রথমে এটি হারাম শরিফের একটি গম্বুজের অংশবিশেষ থাকলেও পরবর্তীতে গ্রন্থাগারটি হারাম শরিফের বাইরে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে এর সংগ্রহে আছে পাঁচ লক্ষাধিক বই। এর মধ্যে ৮ হাজারের অধিক মুদ্রিত-অমুদ্রিত পাণ্ডুলিপি রয়েছে। দুর্লভ পান্ডুলিপি আছে প্রায় ৫ হাজারের মতো। এখানে থাকা ইবনে নাদিমের (মৃত্যু ৪৩৮ হি.) ‘আল-ফিহরিস্ত’, আল্লামা হায়ছামির ‘মাজমাউল বাহরাইন’ গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি পৃথিবীতে এই একটিই। মক্কা লাইব্রেরির বেশ কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। এর পরিসেবা বিভাগটি সাধারণ পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত। লাইব্রেরির বিশাল হলরুমে রয়েছে এক লাখেরও বেশি সংকলন। যে কোনো আগ্রহী পাঠক এখানকার মনোরম পরিবেশে এসে অধ্যয়ন করতে পারেন। লাইব্রেরির পাণ্ডুলিপি বিভাগ নির্ধারিত করা হয়েছে গবেষক ও বিশ্লেষকদের জন্য। গবেষণার জন্য এখানে আছে প্রায় ৬৮৪৭টি মূল পান্ডুলিপি। সেই সঙ্গে ৩৫৮টি অনারবি এবং ২৩১৪টি ফটো পাণ্ডুলিপিও রয়েছে। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রশিক্ষণ বিভাগ, ইলেকট্রনিক লাইব্রেরি বিভাগ, মাইক্রোফিল্ম বিভাগ, ফটো মাইক্রোফিল্ম বিভাগ, হারামাইন স্টল, নারী বিভাগসহ আরও অনেক সুবিধা।

আল আজহার মিসর

বিখ্যাত লাইব্রেরির কথা এলেই মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির নাম আসবেই। শায়খ আবদুহুর তত্ত্বাবধানে ১৮৯৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এখানে দুই লাখের বেশি বই রয়েছে। এ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে প্রাচীন ও দুর্লভ সব বই ও পাণ্ডুলিপি। বিশেষ করে হিজরি নবম শতাব্দী ও তার পরবর্তী যুগের পাণ্ডুলিপির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি সংরক্ষিত আছে এখানে। ২০০৫ সালে এখানকার পাণ্ডুলিপির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ হাজারে। ৬৩টি শাস্ত্র ও বিষয়ে বর্তমানে ৪৫০ আধুনিক শেলফসমৃদ্ধ ৩১৮টি হলরুম আছে লাইব্রেরিটিতে। আছে ৭৪টি কম্পিউটার। আলাদা প্রকাশনা বিভাগও আছে লাইব্রেরির। আছে ২৬টি নিজস্ব প্রেস মেশিন। চার মাজহাবের ফিকহ-হাদিস-ইতিহাস, তাফসির, সিরাত, আধ্যাত্মিকতা, ভাষা-সাহিত্য, বালাগাত ও অলঙ্কার, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থ, রাজত্ব ও বাদশা নামদারদের কথনসহ বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ আছে এখানে।