ঢাকা মেডিকেল: ভয়ংকর ডাক্তার আজিজ!
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগে চাকরি করেন নুসরাত জাহান (ছদ্মনাম)। নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানীতে পাড়ি জমানো নুসরাত একদিন মার্কেটে কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় মোবাইল ফোনে কল করেন তার বিভাগীয় প্রধান আজিজ আহমেদ খান। আলাপচারিতায় নুসরাতের কেনাকাটার বিষয়টি জানতে পেরে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানি থেকে আমি অনেক রকম জিনিসপত্র উপহার পাই। সেসব আমার বাসায় রাখা রয়েছে। তোমার কিছু কিনতে হবে না। একসময় বাসায় এসে দরকারি জিনিস নিয়ে যেও।’
অফিসের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির এমন আশ্বাসে সেদিন প্রয়োজনীয় অনেক কিছু না কিনেই বাসায় ফিরে যান নুসরাত। এরপর একদিন সময় করে যান ওই চিকিৎসকের বাসায়। বাসা খালি দেখে নুসরাত জানতে চান, বাকিরা কোথায়? ওই ডাক্তার বলেন, কেউ বাসায় নেই। এরপর নাশতা করতে জোরাজুরি করেন। এক পর্যায়ে গরম লাগার অজুহাতে নুসরাতকে নিজের বেডরুমে নিয়ে বসান ওই ডাক্তার। এরপর আচমকা দরজা বন্ধ করে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করেন। কৌশলে সেই দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে রাখেন। এরপর ব্ল্যাকমেইল করে দিনের পর দিন চলে ধর্ষণ।
শুধু নুসরাত নন, এভাবে অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের প্রধান ডা. আজিজ আহমেদ খান। তার কাছে সম্ভ্রম হারানো কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা হয়েছে কালবেলার। তাদের জবানিতে উঠে এসেছে ওই চিকিৎসকের ভয়ংকর রূপ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে ডা. আজিজ আহমেদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘আরে এগুলা বাদ দেন। এসব কথা শুনতে ভাল্লাগতেছে না। আপনি পরে এক সময় আসেন, সামনাসামনি আইসেন দেখা করুমনে।’
এরপর তিনি ফোন কেটে দেন। পরে আবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। তার মোবাইল নম্বরে প্রশ্ন লিখে মেসেজ পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালে কর্মচারী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী কেউ বাদ যান না এই চিকিৎসকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে। কোনো টেকনোলজিস্ট বা ইন্টার্ন করতে আসা ছাত্রীকে পছন্দ হলে তার সঙ্গেই প্রথমে খারাপ আচরণ শুরু করেন ডা. আজিজ। নানাভাবে কাজের মাধ্যমে ত্যক্ত করতে থাকেন। ডিউটিতে বেশি সময় রাখা, তুচ্ছ বিষয়ে ধমকানোসহ নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এভাবে প্যাথলজি বিভাগের বেশিরভাগ নারীকে নানাভাবে নাজেহাল করেন ডাক্তার আজিজ। এক পর্যায়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এসব নারীকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করা শুরু করেন তিনি। কখনো ভালো ব্যবহার, কাজের সুযোগ দেওয়াসহ নানাভাবে সুসম্পর্ক তৈরি করেন। সম্পর্কের এক পর্যায়ে কাউকে শারীরিক নির্যাতন করেন, আবার কারও সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে বিশেষ সময়ের স্ক্রিন রেকর্ড ধারণ করে রাখেন। এরপর সেগুলো দেখিয়ে চলে ব্ল্যাকমেইল। বাধ্য করেন শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে। একবার কেউ শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে তার আর নিস্তার নেই। ফেঁসে যান এই নারীলিপ্সু ডা. আজিজের জালে। ভিডিও ছড়ানোর হুমকি দিয়ে এসব ভু্ক্তভোগী নারীকে হোটেল-রিসোর্টে ডাকেন আজিজ। উপায় না পেয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই এই ডাক্তারকে সঙ্গ দিতে হয় এসব ভুক্তভোগী নারীদের।
অভিযোগ রয়েছে, সার্টিফিকেট আটকিয়েও নারী শিক্ষার্থীদের শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করেন এই চিকিৎসক। এরপর বিশেষ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে চলে ব্ল্যাকমেইল। এভাবে দিনের পর ব্ল্যাকমেইল করে নারীদের ধর্ষণ করেন ডা. আজিজ। নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ না করতে দেওয়া হয় হুমকি। ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে দিনের পর দিন নির্যাতন। ফলে লোকলজ্জার ভয়ে অসহায় নারীরা আর কথা বলেন না ডা. আজিজের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালে চাকরি নেওয়া নারীদের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়েও শারীরিক সম্পর্ক করেন এই আজিজ। একবার কেউ আজিজের ফাঁদে পা দিলে তার আর বের হওয়ার সুযোগ নেই। আর আজিজের কথায় রাজি না হলে চলতে থাকে মানসিক নির্যাতন।
জানা গেছে, ডা. আজিজের এই অপকর্ম সম্পর্কে বেশ কয়েকজন নারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলেও পাননি কোনো প্রতিকার।
কালবেলার হাতে আসা এ ধরনের একাধিক অভিযোগের কপিতে দেখা যায়, গত ১৭ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন এক ভুক্তভোগী নারী। অভিযোগে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওই নারী তার প্রতিকার চান। তবে তিনি কোনো প্রতিকার না পেয়ে পুনরায় ১৯ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। তবে এরপরও তিনি কোনো প্রতিকার পাননি। উল্টো তার ওপর ক্ষিপ্ত হন ডা. আজিজ। বাসার সামনে নিজস্ব লোক দিয়ে পাহারা বসিয়ে ওই নারীর গতিবিধির ওপর নজর রাখেন ডা. আজিজ। সন্দেহ হওয়ায় এ ধরনের এক যুবককে আটক করে ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়ার রুমে নিয়ে গিয়েছিলেন ওই নারী। সেখানে ওই যুবক স্বীকার করেন, তাকে ডাক্তার আজিজ পাঠিয়েছেন।
ডা. আজিজের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনে গত ২৯ নভেম্বর রাজধানীর কদমতলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ভুক্তভোগী আরেক নারী, যার নম্বর ২০২৪।
ধর্ষণের শিকার এক নারী কালবেলাকে বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানি থেকে পাওয়া কিছু উপহার দেওয়ার কথা বলে স্যার আমাকে খালি বাসায় ডেকে নেন। এরপর সেখানে নিয়ে জোর করে আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। সেগুলোর ভিডিও ধারণ করে আমাকে দীর্ঘদিন ব্ল্যাকমেইল করে ধর্ষণ করেছেন। তার কথা না শুনলে আমাকে চাকরিচ্যুত এবং অ্যাসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। দীর্ঘদিন ধর্ষণের ফলে আমি এক পর্যায়ে গর্ভবর্তী হয়ে যাই। বিষয়টি তাকে জানিয়ে সম্মান বাঁচাতে আমাকে বিয়ে করার জন্য বলি। তিনি তখন বিয়ে করার আশ্বাসও দেন; কিন্তু এক পর্যায়ে তার রুমে নিয়ে আমাকে একটি ট্যাবলেট খাইয়ে আমার বাচ্চা নষ্ট করে দেয়। এরপর তাকে বিয়ে করতে বললে নানান টালবাহানা শুরু করে। এক পর্যায়ে আমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়। এই বিষয়ে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’
আরেক ভুক্তভোগী নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালবেলাকে বলেন, ‘উনি (ডা. আজিজ) আমাদের বিভাগে ইন্টার্ন করতে আসা বেশিরভাগ মেয়েকে যৌন নির্যাতন করেন। একটা সিঙ্গেল মেয়েও ওনার হাত থেকে বাদ যায় না। আমার নিজেরও সার্টিফিকেট আটকে রেখেছিল। সার্টিফিকেট আটকিয়ে উনি ওনার বাসায় যেতে বলে। বাসায় নিয়ে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করে। এরপর সেগুলো ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে। যারা ওনার কথা না শোনে তাদের সঙ্গে ডিউটি টাইমেও খারাপ আচরণ করে। মা, বাপ তুলে গালাগালি করে।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো লিখিত অভিযোগ আমার কাছে আসেনি।’
বিষয়টি আপনি অবগত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে এ বিষয়ে এক লাইনে বক্তব্য দেওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি খুবই সেনসেটিভ। আপনাকে ডিপলি বিষয়টি বুঝিয়ে বললে বুঝবেন যে, আমি এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশিদা সুলতানা কালবেলাকে বলেন, ‘আসলে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলযুক্ত রিসিভ করা একটি কপি আমাদের কাছে–এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’