পশু কুরবানির আর্থ-সামাজিক উপযোগিতা

মো. তারেকুল ইসলাম

মুসলমানদের জন্য বাৎসরিক সামাজিক বড় দুটি উৎসবের একটি হলো ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ এবং অপরটি হলো ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম আ. এর দুই পূত্রের সংঘটিত হওয়া কুরবানিই ইসলামের ইতিহাসের প্রথম কুরবানি। মুসলমানদের জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ. এর স্বীয় পূত্র ইসমাইল আ. এর স্মারণে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ বছর পূর্ব হতে মুসলিম সমাজে কোরবানি প্রথা পালন হয়ে আসছে। আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক হজরত মুহাম্মদ স. এর মাধ্যমে কুরবানি প্রথা ইসলাম ধর্মে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য ফরজ করে দেওয়া হয়। পবিত্র কুরআনুল কারিমে পশু কুরবানির ব্যাপারে সূরা কাউসারসহ বহু জায়গায় এর ইঙ্গিত ও আদেশ দেওয়া হয়েছে।

শাব্দিকভাবে ‘কুরবানি’ শব্দটি হিব্রু ‘কোরবান’ আর সিরিয়ান ভাষার ‘কুরবানা’ শব্দ দুটির সঙ্গে সম্পর্কিত, যার আরবি মূল ধাতু ‘কুরবুন’, যার অর্থ হলো কারো নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা এবং সান্নিধ্য অর্জন করা। ইসলামি পরিভাষায় কুরবানি হলো প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার একটি প্রক্রিয়া।

বর্তমান সময়ের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার হিশাব অনুযায়ী মানুষের অন্যতম প্রিয় বস্তু হলো অর্থ বা টাকা। এই অর্থ বা টাকার কুরবানির মাধ্যমে মুসলমানগণ পশু ক্রয় করেন এবং যবেহ করার মাধ্যমে ইসলামের এক মৌলিক আইন পালন ও আল্লাহর সন্তুষ অর্জন করতে চান। ধন-সম্পদের মোহ ও মনের পাশবিকতা দূরীকরণের মহান শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর সামর্থবান মুসলমানগণ কুরবানি পালন করে থাকেন। অথচ বাস্তবতায় অনেক নামধারি অসাধু মুসলমানদেরও আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে কুরবানি করতে দেখা যায়।

সাধু-অসাধু লোকদের মধ্যে যারাই কুরবানি করছেন তাদের মনের কথা মহান আল্লাহ তা’য়ালা পরিপূর্ণভাবেই ওয়াকিবহাল। তাই, কুরবানির আইনসঙ্গত কার্যকারণ নিয়ে উত্থাপিত সকল প্রশ্ন আপাতত মূক রেখে এই কুরবানির আর্থ-সামাজিক উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা যাক:

এক.
বাংলাদেশে কুরবানির জন্য চতুষ্পদ প্রাণী হিশেবে গরু, ভেরা, মহিষ, ছাগল ইত্যাকার পশু বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এসব পশু কুরবানি ছাড়াও লাভজনক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের সকল ধর্মের মানুষ এসব প্রাণী পালন করে লাভজনক অর্থ উপার্জন করে আসছে। বিশেষ করে কুরবানির ঈদকে উপলক্ষ করে গৃহস্ত কৃষক ও ব্যবসায়ীগণ পশুপালন ও খামারি করে আমিষের চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন।

গত তিন জুলাইয়ের একটি প্রতিবেদনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বরাতে একটি তথ্য দেখেছিলাম যে, পশু কুরবানির জন্য গরু ৪৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৯, মহিষ ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০৪ এবং ছাগল ৬৫ লাখ ৭৩ হাজার ৯১৫ সহ ভেরা ও অন্যান্য পশুর ভেতর কুরবানি করা হয় প্রায় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু। প্রতি বছর কুরবানির পশু থেকে গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো বেচা-বিক্রি হয়, যা আমাদের দেশীয় অর্থনীতিকে উর্বর ও প্রাণবন্ত রাখতে অনেক বড় একটি ভূমিকা পালন করে।

এদিকে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ভারত থেকে বৈধভাবে গরু আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। কার্যকারণে দেখা যায়, দেশে গবাদিপশুর খামারের সংখ্যাও পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর জুলাই মাসের সাত তারিখে ডয়েচে ভেলের তথ্যমতে, ভারতীয় নিষেধাজ্ঞার পর লক্ষাধিক খামার বৃ্দ্ধির সাথে সাথে মাংস উৎপাদনের হারও বেড়েছে আগের তুলনায় প্রায় ষাট গুণ বেশি।

দুই.
কুরবানির ঈদ উপলক্ষে গ্রামীণ অর্থনীতি সরব হতে দেখা যায়। অনেক গৃহস্ত পরিবার কুরবানির গরু বিক্রির টাকা দিয়ে নিজ কণ্যার বিবাহের আয়োজনসহ বিভিন্ন লাভজনক খাতে এ টাকা বিনিয়োগ করে থাকেন।

তিন.
খামারিগণ ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরে অর্থের সরবরাহ বাড়ায়, ফলে ঋণগ্রহীতা এবং ব্যাংকিং সেক্টর উভয়ই লাভবান হন। গরুর খাদ্যের ভুষি, ঘাসের চাষ এবং ঔষধপত্রের ব্যবসায়ী সরবরাহ বাড়ার সাথে সাথে পরিবহন খাতেও হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়।

চার.
এই উৎসবে রাজধানীতে জমজমাট পশুরহাট লিজ কেন্দ্রিক বিশাল অর্থনৈতিক কার্যক্রম গড়ে উঠে। কুরবানির দিন পশু যবাই ও কাটাকাটি কেন্দ্রিক কশাইদের অর্থ উপার্জনের একটি উৎস তৈরি হয়। একেকজন কশাই পশুকাটার চার্জ বাবদ চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিতে দেখা যায়। পশু কাটার পর কুরবানিদাতা সংগৃহীত মাংস তিন ভাগ করে থাকেন। এক ভাগ কুরবানিদাতা নিজে গ্রহণ করেন, অন্যভাগ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বন্টন করে থাকেন এবং তৃতীয়ভাগ সমাজে অসহায় গরীব, দুস্থদের মাঝে বন্টন করেন, যারা বছরে গরুর মাংস কিনে খেতে পারেন না। এতে করে কুরবানিদাতা ও মাংস গ্রহীতার ভেতর একটি সামাজিক, আত্মিক ও সৌহার্দপূর্ণ বন্ধনও তৈরি হয়।

পাঁচ.
তাছাড়া কুরবানির মাংস রান্নার জন্য প্রয়োজন হয় মশলা জাতীয় দ্রব্যের। এই মশলাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীগণ রমরমা ব্যবসায় মেতে ওঠেন। কাপড় ব্যবসায়ীগণ গোটা বছরের ব্যবসা ঈদ উপলক্ষে অনেকটা সামাল দিতে পারেন।

ছয়.
চলতি বছরের রিজার্ভ ৪৪.১১ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে গিয়ে ৪১ বিলিয়ন ডলারে হৃাস পাওয়ার ফলে সরকার বেকায়দায় পরে যায়। সরকার আশা দেয় যে এই আসন্ন কুরবানির ঈদে রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়বে এবং রিজার্ভের পরিমাণ পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাবে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, আসন্ন কুরবানির ঈদ দেশের জাতীয় উন্নয়নে বিশাল অবদান রাখছে।

সাত.
কুরবানির ঈদের লাভজনক ব্যবসা হলো পশু হতে খালনকৃত চামড়া। প্রতিবছর চামড়া রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হয়। দেশে মোট চামড়ার প্রায় ৮০ শতাংশ সংগৃহীত হয় কুরবানির ঈদের সময়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণ প্রকৃত মূল্য না পাওয়ার কারণে চামড়ার একটি বড় অংশ নষ্ট করে ফেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামগ্রিক চামড়া শিল্প। লবণ ও চামড়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দৌরাত্মের ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। এই ঈদে সরকার সেই দিকটি পূর্ণ সক্ষমতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করবেন বলে আশা রাখি। সার্বিকভাবে বলা যায়, জাতীয় আয় অর্জনে কুরবানির ঈদ একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক লাভজনক উৎসব। একই সাথে মুসলমানদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও নেয়ামত।

মো. তারেকুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়